শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৯

আজ ২৩ শে আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কালো দিবস

২৩ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কালো দিবস। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, ২০০৭ সালের এই দিনে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরে তা অন্যত্র ছড়িয়ে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বারবার মার খাওয়া গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য শিক্ষার্থীদের সর্বশেষ বড় ধরনের লড়াইয়ের ইতিহাসই যেন ছিল সেদিন। কিন্তু কালো দিবস পালন যত সহজ হয়, গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি এবং তাকে জিইয়ে রাখার আকাঙ্ক্ষা ততটা ভিত গাড়ে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বেশ কয়েক বছর ধরেই এই দিবসকে কালো দিবস হিসেবে পালন করছে। নিপীড়নের স্মৃতিকে বিবর্ণতার মধ্য দিয়ে স্মরণ এবং এই ইতিহাসকে প্রচার নিঃসন্দেহে শাসন-শোষণের বিপরীতে গণতন্ত্রমুখিতাকেই গভীরভাবে ইঙ্গিত করে। কিন্তু সব সময় সব ইঙ্গিত-আভাস একই ধরনের যোগসূত্র তৈরি করায় না।
হ্যাঁ, এটি সত্যি, ২০০৭–এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এত বড় প্রতিবাদী আন্দোলন আর হয়নি। সেদিন, ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে আন্তবিভাগ ফুটবল খেলা চলাকালে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী এবং কয়েকজন সেনাসদস্যের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। এর প্রতিবাদ জানিয়ে শিক্ষার্থীরা তাৎক্ষণিকভাবে মিছিল করে। বিক্ষোভ মিছিলে হামলা চালানো হয়। পরদিন ২১ আগস্ট ক্যাম্পাস উত্তাল হয়ে পড়ে। রাস্তায় নেমে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরের শিক্ষার্থী। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা বিক্ষোভ করতে থাকে ক্যাম্পাসে। তখন তাদের ওপর আক্রমণ চালায় পুলিশ। নীলক্ষেত, টিএসটি, কার্জন হল এলাকাসহ পুরো ক্যাম্পাস এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেটে আহত হয় শত শত ছাত্র। সঙ্গে সঙ্গে এ ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেনাক্যাম্প গুটিয়ে নেওয়ার দাবি জানায় শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র থেকে সেনাক্যাম্প সরিয়ে নেয় সেনাবাহিনী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাপিয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। সারা দেশে শুরু হয় আন্দোলন। ২২ আগস্ট সন্ধ্যায় ঢাকাসহ দেশের প্রধান পাঁচটি বিভাগীয় শহরে কারফিউ জারি করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগ করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। আন্দোলন চলাকালেই রাজশাহীতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন রিকশাচালক আনোয়ার।
এর পরদিন ২৩ আগস্ট রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ও অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় অজানা স্থানে। আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করার কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইদুর রহমান খান, আবদুস সোবহান, মলয় কুমার ভৌমিক, দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস, সেলিম রেজা নিউটন ও আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে গ্রেপ্তার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও দুই শিক্ষক এবং পাঁচজন ছাত্রনেতা।
সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষকেরা লড়েছিলেন গণতন্ত্রকে ফানুস বানানোর প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য শিক্ষার্থীরাই লড়েছে বারবার। তাদের লড়িয়ে মেজাজের ওপর ভর দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় রক্ষা পায়, বেঁচে থাকে বাংলাদেশ। তাদের প্রতিবাদী মেজাজের টনিকে মুমূর্ষু গণতন্ত্রের জীবন বারবার ফিরে আসে। অথচ আন্দোলন হলে সেই ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধেই করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভাবমূর্তি’ নষ্টের অভিযোগ। হামলা, মামলা, গ্রেপ্তার এবং শোকজের আতঙ্কে তাদের থাকতে হয়।
এই লড়াকু শিক্ষার্থীদের এ দেশের সব লড়াইয়ের ময়দানের শামিয়ানা টাঙিয়েছিল। তবে সেই গণতন্ত্রের জমিনগুলো আস্তে আস্তে বেদখল হয়ে গেছে। পল্টন বা রেসকোর্সের ময়দানে এখন আর প্রতিবাদী স্বর একত্র হয় না। বেশ কিছুকাল ধরে জমায়েত হতো শাহবাগ কিংবা রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশ। বুক টান টান করে প্রতিবাদ বেঁচে থাকত। অথচ গণতন্ত্রের জন্য ‘মাথা না নোয়ানোর’ মতো গর্ব করা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আর গণজমায়েতের স্থান নেই। মেট্রোরেলের উন্নয়ন তরঙ্গ ভাগ করেছে শাহবাগ থেকে টিএসসির এপাশ-ওপাশকে। চাইলেই কেউ দৌড় দিয়ে নিজেকে মিছিলে শামিল করতে পারবে না। আর উন্নয়নের তোড়ে বিক্ষোভের জমিনগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। গণজমায়েতের আশঙ্কাকে আর ভয় করতে হয় না।

শাসন–শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের যে ইতিহাস এই অঞ্চলে আছে, গণতন্ত্র রক্ষার যে তীব্র তাড়না এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়, যে মতাদর্শিক সুড়সুড়ি আমাদের নিয়ে যায় প্রতিবাদী মিছিলে, সেটি জারি আছে, কিন্তু পরিসরটি, দাঁড়ানোর জমিগুলো কখনো উন্নয়নের নামে, কখনো নিরাপত্তা নামে কেড়ে নেওয়া হয়েছে, ভেঙে দেওয়া হয়েছে, হচ্ছে। যে দেশ কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের সংস্কৃতির বিপরীতে সয়ে যাওয়ার সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে, সে দেশে আর যা–ই হোক গণতন্ত্রের উচ্ছলতা কিছুতেই বোধ হয় না।

তবু মানুষের রুদ্ধশ্বাস অস্বস্তিতে ওরা ভয়ে থাকে। কারণ, ওরা ভয় পায় জীবনে, ওরা ভয় পায় মরণে। ওরা ভয় পায় প্রতিবাদের স্মৃতিকে, প্রতিরোধের মূর্তিকে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের সঙ্গে ঠেস দিয়ে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কালো দিবস পালনের পাশাপাশি আশকারা দিতে হবে ছিনা টান টান করে দাঁড়ানোর ভঙ্গিকে। বন্ধ নয়, বরং মেলে দিতে হবে দাঁড়ানোর জায়গাগুলোকে। খুলে দিতে হবে সব চিন্তার জানালা। শাণ দিতে হবে মুক্তির যুক্তিকে। উসকে দিতে হবে প্রতিবাদী চিন্তাকে। কারণ, গণতন্ত্র না বাঁচলে বেঁচে থাকবে না মানুষ, শিক্ষা, সংস্কৃতি কিংবা ইতিহাস। বিশ্ববিদ্যালয়কে এই বিশ্বাসেই দৃঢ় থাকতে হবে যে প্রতিবাদ, প্রতিরোধের সংস্কৃতি ‘ভাবমূর্তিকে’ নোয়ায় না, বরং উজ্জ্বল ও ইতিহাসঘেঁষা করে।

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: