শুক্রবার, ২৭ আগস্ট, ২০২১

নজরুল ম্মৃতিতে ঢাকা

নজরুল–স্মৃতিতে ঢাকা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুদিন আজ। জীবদ্দশায় অনেকবারই ঢাকায় এসেছেন নজরুল। এ লেখায় আছে বিভিন্ন সময়ে কবির ঢাকা সফরের বিত্তান্ত কাজী আলিম-উজ-জামান প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২১, ১০: ০১ অ+ অ- জায়গাটি ঢাকার বনগ্রাম লেন। নিম্নমধ্যবিত্ত এই পাড়ায় শিক্ষিত-সংস্কৃতিমনা মানুষের বড্ড অভাব। গান জানকোনো তরুণীর পক্ষে এ রকম পাড়ায় দিনযাপন সহজ নয়। তেমনই এক বিষণ্ন বিকেলে বনগ্রামের বাড়ির দোতলার ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়ান রানু সোম। একটা ফিটন গাড়ি বাড়ির সামনে এসে থামে। সময়টা ১৯২৮ সাল, বাংলা মাস আষাঢ়। রানুর কথায়, ‘বাঙালির তুলনায় একটু বেশিই স্বাস্থ্যবান ও সুশ্রী এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন দরজায়, এক মুখ হেসে গায়ের গেরুয়া চাদর সামলাতে সামলাতে আমাকে ঠেলেই প্রায় ঢুকে এলেন ঘরে।’ এই রানু সোম বা প্রতিভা সোম, যিনি পরবর্তী সময়ে প্রতিভা বসু। পৈতৃক নিবাস মুন্সিগঞ্জের হাঁসাড়া। সুসাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগেই সংগীতশিল্পী হিসেবে যিনি জনপ্রিয়, প্রেমের গান গেয়ে রাতারাতি নাম কিনে ফেলেছেন। গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে বছরে ৬টি রেকর্ড, অর্থাৎ ১২টি গান বেরোয় তাঁর। তত দিনে নজরুলসংগীতেও হাতেখড়ি হয়ে গেছে এবং এখানে-ওখানে নজরুলসংগীত গেয়ে প্রশংসাও পাচ্ছেন। আর নজরুল ইসলামের গান ও বিপ্লবী কবিতায় তখন সারা বাংলা মাতোয়ারা। যার গলায় সুর নেই, তার মুখেও শোনা যায়, ‘কে বিদেশি বন উদাসী, বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে’। আর ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে’ গাইতে গাইতে ছেলেরা ঢোকেন কারাফটকে। এই রানু সোমের কথা নজরুল জানতে পারেন গীতিকবি দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের পুত্র প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ দিলীপ কুমার রায়ের কাছে, যার ডাকনাম ছিল মন্টু। আর মন্টু ছিলেন নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নজরুল ইসলামের বয়স তখন ২৯ কি ৩০। পুরান ঢাকার বাড়িতে প্রথম দেখায় নজরুলের চেহারার বর্ণনা ‘জীবনের জলছবি’ বইতে রানু এভাবে দিয়েছেন, ‘যৌবন তার চোখে-মুখে, সারাক্ষণ হাসিতে সমস্ত শরীরে নদীর স্রোতের মতো বহমান, বেগবান। সেই বয়সে যারা তাকে দেখেছেন শুধু তাদেরই বোঝানো যাবে কী দুকূলপ্লাবী আনন্দধারা দিয়ে গড়া তার চরিত্র। মস্ত বড় বড় কালো টানা চোখ, এলোমেলো ঘন চুলের বাবরি, তীক্ষ্ণ নাসিকা, ঘষা তামার মতো রং, সহজ সরল অদাম্ভিক ব্যবহার, উদ্দাম হাসি, উচ্ছ্বাস প্রবণতা, সবটা মিলিয়ে একটা ব্যক্তিত্ব বটে। আর তার ধুলোয় লুটিয়ে পড়া গেরুয়া চাদর।’ নজরুলের সেবার (১৯২৮) ঢাকায় আসাও কম চমকপ্রদ ছিল না। প্রতিভা বসুর বর্ণনায়, গড়ের মাঠে খেলা দেখে এক বন্ধুর সঙ্গে ইস্ট বেঙ্গল-মোহনবাগান তর্ক করতে করতে চলে আসেন শিয়ালদহ স্টেশনে। দেখেন ঢাকা মেইল দাঁড়িয়ে আছে। অমনি উঠে পড়েন। সেবার এসে তিনি ওঠেন বন্ধু খ্যাতিমান দাবাড়ু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের বাসায়। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের হাউস টিউটর হিসেবে বর্ধমান হাউসের দোতলায় বাস করতেন মোতাহার হোসেন, যেটা এখন বাংলা একাডেমির অংশ। মোতাহার হোসেন নজরুলের চেয়ে বয়সে দুই বছরের বড় ছিলেন এবং সম্পর্ক ছিল ‘তোমা-তুমি’র মতো। ভালোবেসে নজরুল তাঁকে ডাকতেন ‘মোতিহার’ বলে। নজরুল ইসলামের বয়স তখন ২৯ কি ৩০। পুরান ঢাকার বাড়িতে প্রথম দেখায় নজরুলের চেহারার বর্ণনা ‘জীবনের জলছবি’ বইতে রানু এভাবে দিয়েছেন, ‘যৌবন তার চোখে-মুখে, সারাক্ষণ হাসিতে সমস্ত শরীরে নদীর স্রোতের মতো বহমান, বেগবান। সেই বয়সে যারা তাকে দেখেছেন শুধু তাদেরই বোঝানো যাবে কী দুকূলপ্লাবী আনন্দধারা দিয়ে গড়া তার চরিত্র। মস্ত বড় বড় কালো টানা চোখ, এলোমেলো ঘন চুলের বাবরি, তীক্ষ্ণ নাসিকা, ঘষা তামার মতো রং, সহজ সরল অদাম্ভিক ব্যবহার, উদ্দাম হাসি, উচ্ছ্বাস প্রবণতা, সবটা মিলিয়ে একটা ব্যক্তিত্ব বটে। আর তার ধুলোয় লুটিয়ে পড়া গেরুয়া চাদর। ওই আষাঢ়স্য দিবসে (১৯২৮) সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রানুকে গান শেখানোর পর পরদিন সকালে নজরুল আবার যান তাঁদের বাড়িতে। কিছুটা অবাক হন রানুও। নজরুল বর্ধমান হাউস থেকে প্রাতর্ভ্রমণ করতে করতে পৌঁছে যান বনগ্রাম। ঢাকার অনেক সংগঠন এ সময় নজরুলকে তাদের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করত। রানু সোমের বর্ণনায় নজরুলের কথায়, ‘উঃ কী করে ছেলেগুলো। ওদের পাল্লায় পড়লে উপায় আছে, ঠিক কোথাও না কোথাও ধরে নিয়ে যাবে।’ মূলত তাদের এড়ানোর জন্যই তিনি সকাল সকাল রানুদের বাড়ি গিয়ে আত্মরক্ষা করেন। আগের রাতে লেখা গান ‘আমার কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী, এ কোন সোনার গাঁয়, আমার ভাটির তরী আবার কেন উজান যেতে চায়’ হারমোনিয়ামে সুর তুলে রানুকে শিখিয়ে দেন। এর আগের বছরই, ১৯২৭ সালে ঢাকায় এসেছিলেন নজরুল ইসলাম। কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর স্মৃতিকথার ‘স্মৃতিপটে নজরুল’ অংশে উল্লেখ করেছেন, ১৯২৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নজরুল ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলে (সলিমুল্লাহ মুসলিম হল নামকরণ তখনো হয়নি) ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেন। গোয়ালন্দ থেকে লঞ্চে নারায়ণগঞ্জে আসার পথে একটি গান রচনা করেন তিনি। সম্মেলনে ‘খোশ আমদেদ’ নামে উদ্বোধনী গীতি হিসেবে ওই গানটি গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেন। গানটি ছিল: ‘আসিলে কে গো অতিথি উড়ায়ে নিশান সোনালি! ও চরণ ছুঁই কেমনে দুই হাতে মোর মাখা যে কালি॥ দখিনের হালকা হাওয়ায় আসলে ভেসে সুদূর বরাতী! শবে’রাত আজ উজালা গো আঙিনায় জ্বলল দীপালি॥ তালি-বন ঝুমকি বাজায় গা ‘মোবারক-বাদ’ কোয়েলা। উলসি’ উপচে প’ল পলাশ-অশোক-ডালের ঐ ডালি॥’ মোতাহার হোসেনের কথায়, ‘এই গান শুনে সুরের বিপুল উচ্ছ্বাসে সুধীগণ এমনকি মোল্লা-মৌলবীগণ পর্যন্ত উল্লসিত হয়ে উঠলেন।’ তাদের কথা, ‘কী সুন্দর ইসলামী গান, ঠিক যেন গজল।’ ২৭ ফেব্রুয়ারি এসে ১ মার্চ নজরুল ঢাকা ত্যাগ করেন। বিজ্ঞাপন ২. তবে নজরুলের ১৯২৮ সালের ঢাকা সফরই বেশি আলোচিত ছিল। ওই বছর দুবার তিনি ঢাকায় আসেন। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে এসে অবস্থান করেছিলেন ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আবার আসেন আষাঢ় মাসে। রানুর সঙ্গে পরিচয় হয় আষাঢ়ে। আরও পরিচয় হয় ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ, রমনা হাউসের বাসিন্দা সুরেন্দ্র মৈত্রের কন্যা উমা মৈত্র ওরফে নোটনের সঙ্গে। নোটন ছিলেন চিত্রশিল্পী ও পিয়ানোর শিক্ষার্থী। অপূর্ব সুন্দরী নোটনকে কাজী মোতাহার হোসেন ‘কাব্যপ্রেরণাদায়ী আনন্দের নির্ঝরিণী’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। পরিচয় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের মেধাবী ছাত্রী ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গেও। ‘ফজিলাতুন্নেসা অসামান্য সুন্দরী ছিলেন না, ছিলেন একজন উঁচুদরের বাকপটু মেয়ে।’ নজরুল ইসলাম হস্তরেখা দেখে ভাগ্য গণনা করতে পারেন, কাজী মোতাহার হোসেনের কাছ থেকে এ কথা জেনে ফজিলাতুন্নেসা নজরুলের কাছে হাত দেখাতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। একদিন কবিকে নিয়ে মোতাহার হোসেন গেলেন তাঁর গৃহে। মোতাহার হোসেনের বর্ণনায়, ‘প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কবি ফজিলতের হাতের মস্তিষ্করেখা, জীবনরেখা, হৃদয়রেখা, সংলগ্ন ক্ষুদ্র রেখাসমূহ এবং সেই সঙ্গে ক্রস, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ সমন্বিত অন্যান্য মাউন্ট, শুক্র, শনি, রবি, বুধ, মঙ্গল ও চন্দ্রের অবস্থানগুলো নিরীক্ষণ করলেন, কিন্তু এগুলোর সম্বন্ধ-সূত্রের ফলাফল নির্ণয় করতে ব্যর্থ হলেন। তিনি একজন জ্যোতিষির মতো সূর্য-চন্দ্রের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত তারকার অবস্থান টুকে নিলেন এবং রাত্রিতে তিনি বিশদ পরীক্ষা করবেন বলে জানালেন।’ বর্ধমান হাউসের বাসায় ভাইবোনসহ পরিবারের অনেক লোক থাকায় মোতাহার হোসেনও বাইরের ছোট ঘরে নজরুলের সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমাতেন। মোতাহার হোসেন লিখেছেন, ‘পরদিন সকালে উঠে দেখি নজরুল বিছানায় নেই। ব্যাপার কি? পরে অনেক বেলাতে জানা গেল, কখন যেন তিনি আলগোছে উঠে চলে গিয়েছিলেন, পুরান ঢাকার দেওয়ানবাজার রাস্তার ওপর অবস্থিত ফজিলতের গৃহে।’ তবে এ বিষয়ে তিনি নজরুলকে কিছু জিজ্ঞাসা করেননি। পরদিন একটা ঘটনা লক্ষ করেছিলেন তিনি, ফজিলতের গলার লম্বা মটরমালার হারটা ছিন্ন। এরপরই নজরুল ঢাকা থেকে কলকাতায় চলে যান। সেখানে গিয়ে মোতাহার হোসেনের মাধ্যমে ফজিলতের কাছে কয়েকখানা কাব্যিক চিঠি পাঠিয়েছিলেন। পরে অধ্যাপক সৈয়দ আলী আশরাফ সেই চিঠিগুলো বিশ্লেষণ করে নজরুল-চরিতের একটা দিক উদ্‌ঘাটন করার চেষ্টা করেন (‘নজরুল জীবনে প্রেমের এক অধ্যায়’, সম্পাদনা সৈয়দ আলী আশরাফ)। নজরুলের ওভাবে চলে যাওয়ায় কষ্ট পান বুদ্ধদেব বসুও। বুদ্ধদেব ঢাকা কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই নজরুলের সান্নিধ্যে আসেন। পরে নজরুল আষাঢ় মাসে (১৯২৮) আবার এলে তাঁকে জগন্নাথ হলে এক অনুষ্ঠানে নিয়ে যান তৎকালীন ঢাকার উজ্জ্বল তরুণ বুদ্ধদেব। ‘আমার যৌবন’-এ তিনি নজরুলের চেহারার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ‘সব মিলিয়ে মনোলুন্ঠণকারি এক মানুষ’। ঢাকা কলেজের ছাত্র অবস্থায় বন্ধুদের নিয়ে বুদ্ধদেব থাকতেন পুরানা পল্টনের এক টিনের ছাপড়ায়। ‘প্রগতি’ নামে হাতে লেখা পত্রিকা বের করতেন। সেই ঘরেও নজরুলকে নিয়ে গেছেন বুদ্ধদেব। নজরুল গিয়েছেন আশেক লেনে অজিত দত্তের বাড়িতেও। বুড়িগঙ্গা পাড়ে বাকল্যান্ড বাঁধের ওপর দিয়েছেন জমজমাট আড্ডা। (‘ঢাকার বুদ্ধদেব বসু’, সৈয়দ আবুল মকসুদ)। আরেকবার (১৯২৮) নজরুলের কাছে গানের আমন্ত্রণ আসে বুড়িগঙ্গাতীরের জমিদার রূপবাবুর কাছ থেকে, পুরোনো হাইকোর্টের অঙ্গনে অবস্থিত অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের গৃহসহ বহু বুদ্ধিজীবী, কৃষ্টিমান নাগরিকের কাছ থেকে। মোতাহার হোসেন লিখেছেন, নজরুল সেদিন রূপবাবুর বাড়িতে অনেকগুলো গান গেয়েছিলেন। ঢাকার সব অভিজাত ব্যক্তি সেখানে সমবেত হন। বুড়িগঙ্গাতীরে নজরুলের গান এক মোহনীয় পরিবেশ তৈরি করেছিল সেদিন (১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস)। বইপত্র থেকে জানা যায়, ঢাকায় অবস্থানকালে নজরুলের প্রিয় জায়গা ছিল রমনা লেক। লেকের ধারে ছিল সাপের আস্তানা। সেটা জেনেও তিনি সকাল-বিকেল লেকের পাড়ে বসে সময় কাটাতেন। নজরুলের ঢাকা সফরকালে (১৯২৭-২৮) তাঁর ছায়াসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা প্রাবন্ধিক কাজী আবদুল ওদুদ ও কবি আবদুল কাদির। পরে নজরুল অসুস্থ হলে ১৯৪৩ সালে তাঁরা দুজনই কিছু অর্থসহায়তা নিয়ে কলকাতায় কবির শয্যাপাশে উপস্থিত হয়েছিলেন। বর্ধমান হাউসের বাসায় ভাইবোনসহ পরিবারের অনেক লোক থাকায় মোতাহার হোসেনও বাইরের ছোট ঘরে নজরুলের সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমাতেন। মোতাহার হোসেন লিখেছেন, ‘পরদিন সকালে উঠে দেখি নজরুল বিছানায় নেই। ব্যাপার কি? পরে অনেক বেলাতে জানা গেল, কখন যেন তিনি আলগোছে উঠে চলে গিয়েছিলেন, পুরান ঢাকার দেওয়ানবাজার রাস্তার ওপর অবস্থিত ফজিলতের গৃহে।’ ৩. বনগ্রামের বাড়িতে বসে নজরুল কেন রানু বা প্রতিভা বসুকে এত গান শেখাতে আগ্রহী হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে কাজী মোতাহার হোসেন আলোচনা করেছেন। তা ছিল দিলীপ রায়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা। দিলীপ রায় এর আগে ঢাকায় এসে টিকাটুলী অধিবাসিনী রেনুকা সেনকে গান শিখিয়েছিলেন। দিলীপ রায়ের শেখানো ‘পাগলা মনটারে তুই বাঁধ’ শিরোনাম একটি গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। নজরুল চেয়েছিলেন রানুকে দিয়ে রেনুকার চেয়েও উৎকৃষ্ট গান গাওয়াতে। তবে তৎকালীন ঢাকার রক্ষণশীল বাসিন্দারা বাড়িতে গিয়ে রেনুকাকে দিলীপ রায়ের গান শেখানো যেমন পছন্দ করেনি, তেমনি করেনি রানুকে নজরুলের গান শেখানো। এ নিয়ে সজনীকান্তের ‘শনিবারের চিঠি’তেও ব্যঙ্গ করা হয়। এরা লিখেছিল, ‘কে বিদেশী বনগাঁ-বাসী বাঁশের বাশী (লাঠি?) বাজাও বনে।’ সত্যিই ঠাঁটারীবাজার মোড়ে রাত ১০টা কি ১১টার দিকে রানুকে গান শিখিয়ে ফেরার পথে ১০–১২ জনের একদল হিন্দু যুবক নজরুলকে আক্রমণ করে। নজরুলও জওয়ান-মর্দ মানুষ ছিলেন। বেতের মুঠোওয়ালা একটি লাঠি কেড়ে নিয়ে তাদের দু–এক ঘা কষে দৌড়ে বর্ধমান হাউসে চলে আসেন। ‘জীবনের জলছবি’তে এ ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। কিছুটা সংক্ষিপ্তভাবে আছে মোতাহার হোসেনের ‘স্মৃতিকথা’য়। এ নিয়ে তখন ঢাকায় কোনো পক্ষ আর উচ্চবাচ্য করেনি। তবে নজরুলের কেড়ে আনা সেই লাঠি মোতাহার হোসেন প্রায় আট বছর সংরক্ষণ করেছিলেন। একদিন সাপ মারতে গিয়ে সাপের সঙ্গে সঙ্গে লাঠিটিরও ইন্তেকাল ঘটে। নজরুলের ১৯২৬ সালে দুবার, ১৯২৭ সালে একবার, ১৯২৮ সালে দুবার এবং ১৯৪০ সালে একবার—মোট ছয়বার ঢাকায় আসার বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে সত্য। প্রাবন্ধিক, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘ঢাকার বুদ্ধদেব বসু’ বইতে জানাচ্ছেন, নজরুল ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকে ১৯২৬–এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় আড়াই মাস ঢাকায় ছিলেন। বালক বয়সের ত্রিশাল অধ্যায় বাদ দিলে ১৯২১ থেকে ১৯২৫–এর মধ্যে নজরুলের একাধিকবার কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম আসার তথ্য রয়েছে। নজরুলের ঢাকা সফর নিয়ে অনেক মিথ প্রচলিত আছে। পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্য গোষ্ঠীর কেউ কেউ তাঁদের পূর্ববর্তী প্রজন্মকে উদ্ধৃত করে বলে থাকেন, নজরুল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে ঢাকার রাস্তায় গান গেয়ে গেয়ে চাঁদা তুলেছেন। পুরান ঢাকার বেচারাম দেউড়িতে অবস্থিত কাশ্মীরি শাহ সাহেবের মাজারের সামনে বসে ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল’ গানটি লিখেছেন। তবে এসবের কোনো দালিলিক তথ্য পাওয়া যায় না। মূলত নজরুলের ঢাকা জীবন নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা কাজের সুযোগ এখনো রয়েছে।

শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: